চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে গড়ে ওঠা দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙা শিল্প ফৌজদারহাট-বারআউলিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে এখন কুমিরা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। বিগত এক বছরে বারআউলিয়া এবং কুমিরা অঞ্চলে গড়ে উঠেছে ৬টি শিপইয়ার্ড। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো ৭টি। আর শিপইয়ার্ডের সংখ্যা বাড়তে থাকায় লোহা উৎপাদন বেড়ে দেশের নির্মাণ শিল্পে গতিশীলতা ফিরে আসার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ছে, আর ঘটেছে ব্যাপক কর্মসংস'ানও। ফলে জাহাজ ভাঙা শিল্প দিন দিন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তবে উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে উপকূলীয় বনবিভাগ।
সূত্রে জানা যায়, ৬০ এর দশকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট সমুদ্র উপকূলে ঝড়ে আটকে যাওয়া জাহাজ কুইন আল পাইন ভেঙে স্স্থানীয় কয়েকজন পুঁজিপতি এখানে জাহাজ ভাঙা শিল্পের সূচনা করেন। তারপর এ ব্যবসায় ব্যাপক লাভ এবং জাহাজের প্রতিটি সামগ্রীর চাহিদার কথা বিবেচনা করে ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলতে থাকে শিপইয়ার্ড। ফলে মাত্র দুই দশক অর্থাৎ ৮০ এর দশকের মধ্যে উপজেলার ফৌজদারহাট থেকে বারআউলিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ কি. মি. এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ কামাল উদ্দিন এ প্রতিবেদককে জানান ইয়ার্ডগুলো থেকে বার্ষিক প্রায় ১৭ থেকে ১৮ লক্ষ টন লোহা পাওয়া যাচ্ছে এবং সরকার পেয়ে আসছে প্রায় ৮শ কোটি টাকা বার্ষিক রাজস্ব । এছাড়া প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পাঁচলক্ষ লোকের কর্মসংস'ান করছে এ শিল্প। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে এখানে ইয়ার্ড সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকলেও বিগত এক বছর সময়ে বারআউলিয়া এবং কুমিরা এলাকায় নতুন করে গড়ে উঠেছে ৬টি শিপইয়ার্ড। এ সময়ে জাহাজ ভাঙা শিল্পের দীর্ঘদিনের ফৌজদারহাট-বারআউলিয়া মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে কুমিরা এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে শিপব্রেকিং শিল্প। সরকার এক ঘোষণাপত্রে বড়কুমিরা ইউনিয়নের উত্তর সীমানা পর্যন্ত শিপইয়ার্ড এলাকা ঘোষণা করে, এই ঘোষণার আলোকে কুমিরা এলাকায় বেশ কয়েকটি শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা হয়। বড়কুমিরায় রাজা কাশেমের মালিকানায় রাজা শিপব্রেকিং ইয়ার্ড এবং মোজাহের সওদাগরের মালিকানায় নিউ সিক্স স্টারটিও এখন পুরোদমে চলছে। ফলে বর্তমানে সীতাকুণ্ডে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের সংখ্যা ৪২টিতে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে শুধু নতুন ৬টি ইয়ার্ড চালু হওয়া নয়, একই এলাকাতে কমপক্ষে আরো ৭টি ইয়ার্ড খুব শীঘ্রই নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আর শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের সংখ্যা বাড়তে থাকায় দেশের অর্থনীতিতে তা ইতিবাচক ভূমিকাও রাখছে। নতুন গড়ে উঠা এই ৬টি শিপইয়ার্ডে কর্মসংস'ান হবে আরো প্রায় ৩ হাজার লোকের। তাছাড়া এই ইয়ার্ডগুলো থেকে দেশ পাবে প্রতিবছর আরো ৩ লক্ষ টন লৌহ সহ তামা, পিতল, ফার্নিচারসহ বিভিন্নরকম সামগ্রী। আর সরকার পাবে পৌনে ২শ কোটি টাকা রাজস্ব। প্রক্রিয়াধীন আরো ৭টি ইয়ার্ড গড়ে উঠলে আনুপাতিক হারে লৌহ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস'ান এবং রাজস্ব আয়। মো. কামাল উদ্দিন জানান, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমদানি উন্মুক্ত করার ফলে দেশের ভাসমান খনি খ্যাত একমাত্র শিপব্রেকিং শিল্পের প্রসার ঘটেছে খুবই দ্রুত। যার সুফল পাচ্ছে ভোক্তারা। তবে সরকারকে কঠোর তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে এ ব্যবসাকে সিন্ডিকেট মুক্ত রাখতে হবে। তা না হলে গুটিকয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে দেশের নির্মাণ শিল্প জিম্মি হয়ে পড়বে।
এদিকে নতুন করে শিপ ইয়ার্ড নির্মাণ করতে কিছু কেওড়া গাছ কাটতে বাধ্য হচ্ছে ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ। কারণ, কেওড়া গাছের মালিক উপকূলীয় বন বিভাগ হলেও ভূমিগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন। ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ জমিগুলো ব্যক্তি মালিকদের কাছ থেকে ক্রয় করেছেন। ঐ জায়গায় বনবিভাগের বপন করা কেওড়া গাছ থাকায় ইয়ার্ড নির্মাণে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকায় বহু লোক প্রাণ হারায়। সে সময় বেড়ি বাঁধ এলাকায় কেওড়া বন না থাকায় এই এলাকার ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মতামত প্রদান করায় বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও বন বিভাগ বেড়ি বাঁধ এলাকায় কেওড়া বন গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেন এবং বন বিভাগ কেওড়া গাছের চারা সরবরাহ করে আর এলাকার লোকজন, সামাজিক সংগঠন বিশেষ করে চক্রবাক ক্লাব, ফুটন্ত গোলাপ, বারআউলিয়াস' একটি ক্লাব সেচ্ছাশ্রমে সে চারাগুলো রোপণ করে। বেড়ি বাঁধের ভিতর জমির মালিকানার উৎস জানতে গিয়ে জানা যায়, ১৯৬৫, ১৯৮৬, ১৯৯১ সালসহ বিভিন্ন সময়ে জলোচ্ছ্বাসে সোনাইছড়ী, কুমিরা উপকূলীয় এলাকায় অনেক বাড়ি ঘর সাগরে ভাসিয়ে নেয়। এর পর এ সব এলাকায় প্রাণের ভয়ে কেউ বাড়ি ঘর করে নি।তারা আরো পূর্ব দিকে এসে বসবাস গড়ে তোলে। পূর্বের ভিটা বাড়ি একবার সাগরে তলিয়ে যায় আবার চর জাগে এভাবেই কেটে যায় যুগ যুগ। এই পরিত্যক্ত জায়গায় বন বিভাগ কেওড়া গাছ লাগানোর সময় জমির মালিকের কাছ থেকে অনুমোদন নেননি। সেই এক সময়ের পরিত্যক্ত জায়গায় শিপইয়ার্ড নির্মাণ করতে চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় উপকূলীয় বন বিভাগ। তারা এসব গাছ কাটতে বাধা দিচ্ছে, ইয়ার্ডের মালিকদের বিরুদ্ধে গাছকাটার অপরাধে মামলা দিচ্ছে। পরিবেশ বাদী সংগঠনগুলো বিশেষ করে “বেলা” পরিবেশ বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ এনে হাই কোর্টে মামলা দিচ্ছে। এসব জুট ঝামেলায় পড়ে ভূমি মন্ত্রণালয়, ইয়ার্ড নির্মাণে সরকারি জলাশয় ভূমি লিজ প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে শিপইয়ার্ড উন্নয়ন, জনবলের কর্ম সংস'ান ও রাজস্ব আহরণের পথে একটি বড় বাধা সৃষ্টি হয়েছে। সীতাকুণ্ড সহকারি কমিশনার (ভূমি) গাউসুল আজম এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তার অফিসের রেকর্ড পত্র যাচাই করে জানান মধ্য সোনাইছড়ী মৌজার (জে,এল নং ৪৮) বন বিভাগের নামে কোন রেকর্ড প্রচারিত হয়নি এবং মালিকানাও নেই। এই মৌজার ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি সাগর গর্ভে শুধু বিলীন হয়েছে, নতুন চর জেগে উঠেনি। ফলে বন বিভাগকে সরকারিভাবে মধ্য সোনাইছড়ী মৌজায় (জে এল নং-৪৮-এ) কোন জমি হস্তান্তর করা হয়নি ।
অপরদিকে সীতাকুণ্ড উপকূলীয় বন কর্মকর্তা জান মোহাম্মদ খানের সাথে তার মোবাইলে (০১৭১২-১০১০১৮) যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক জান মালের ক্ষতি হলে সকল উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন করার জন্য সরকার নির্দেশ দেন। তাছাড়া চট্টগ্রাম কোস্টাল এরিয়ায় ১ লাখ ৯৫ হাজার একর জমি হুকুম দখল করার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয় যা এখনো প্রক্রিয়াধীন আছে। সেই প্রস্তাবনার আলোকে তখনকার উপকূলীয় জলাশয়ে কেওড়া গাছ লাগানো হয়। সেই বন কর্তনের অভিযোগে ১১টি মামলা হয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, দেশের উন্নয়ন স্বার্থে শিপইয়ার্ড নির্মাণে সকল বাধা নিরসন করা জরুরি। তবে তা আইনের মধ্যে এবং পরিবেশ বান্ধব হতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন