বৃহত্তর চট্টগ্রামের ব্যাপক এলাকায় প্লাবন, হাজার হাজার লোক পানিবন্দি ।।চকরিয়া রামু উখিয়া পেকুয়া নাইক্ষ্যংছড়িতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, চিংড়ি ঘের নষ্ট



টানা প্রবল বর্ষণ ও বিভিন্ন ছড়া-খাল দিয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে চকরিয়া, রামু, উখিয়া, পেকুয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বহু চিংড়ি ঘের প্লাবিত হয়েছে। আজাদীর নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি মাঈনুদ্দিন খালেদ জানান, পার্বত্য উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ি ও রামুতে মাত্র ৬ ঘণ্টা টানা বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে কোটি টাকার ১টি ব্রিজ এবং কালর্ভাট, ১০টি বসতঘরসহ শতাধিক গরু, ছাগল, হাস, মুরগি, ধান, চাল, বাঁশসহ কয়েক কোটি টাকার মালামাল ভেসে যায়। বজ্রপাতে নিহত হয় নারীসহ ২ জন, আহত হয় ৮ জন। পাহাড়ি এ ঢলে দু’উপজেলার সাথে সংযুক্ত ৪টি সড়কের সকল ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ২০ ঘণ্টা। পৃথক ঘটনায় কচ্ছপিয়ার মৌলভীরকাটায় ৪র্থ শ্রেণীর এক ছাত্রী মারা যায়। তার নাম আক্তার বেগম (১০), তার মৃত্যু কারণ জানা যায় নি। সব মিলে এলাকায় হঠাৎ নেমে আসে এক অরাজক পরিসি'তি। ৫৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এ খবর প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী ও দায়িত্বশীল সূত্রের। সূত্র জানায়, সীমান্ত উপজেলাদ্বয়ে গত ৭ জুন রাত ৮টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত টানা বর্ষণে হঠাৎ করে পানি পূর্ণ হয়ে যায় স'ানীয় নদী ও খালগুলো। পাহাড়ি এ ঢলে সৃষ্টি হয় বন্যার। এরই সাথে বজ্রপাতের গর্জন ও আঘাত। অরাজক এ পরিস্থিতে লোকজন জীবন বাঁচাতে মরিয়া ছিল তখন। এ সময় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী সংযোগ সড়কের থোয়াংগাকাটা নামক স্থানে গর্জনছড়াতে নির্মাণাধীন ুইচ গেটের জমা পানিতে ১০টি বসতবাড়ি, ৬টি গরু, ২টি ছাগলসহ শতাধিক হাঁসমুরগি ভেসে যায়। এ স্লুইচ গেটের পানিতে বন্দি হয়ে পড়ে বাইশারী ইউনিয়নের নাজির বুনিয়াসহ ৫ গ্রামের ৮ হাজার মানুষ। এভাবে উপজেলার বাইশারীতে ভেসে যায় পুনর্বাসন পাড়া সংযোগ সড়কের ২ কিলোমিটার চলাচল পথ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাইশারী-ঈদগাঁও সড়ক, নাইক্ষ্যংছড়ি-চাকঢালা সড়ক, ঘুমধুম-রেজু সংযোগ সড়ক ও বাইশারী-গর্জনিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক। উপজেলায় অন্তত অর্ধশত কালভার্ট ভেঙে যায়। এখানকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ ৫৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। কোন পড়ালেখা হয়নি। কচ্ছপিয়া কে.জি স্কুল এন্ড কলেজসহ বেশ কয়েকটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। একই সময়ে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের দোছড়ি খালে নবনির্মিত কোটি টাকার ব্রিজটি নির্মাণ ত্রুটির কারণে ভেসে যায়। এতে করে ১০ হাজার মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গর্জনিয়া ইউনিয়নের থিমছড়ি বাজার সংলগ্ন খালে ৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ব্রিজটি নির্মাণের ২ মাসের মাথায় গতকালের পানিতে ভেসে যায়। একই ইউনিয়নের জাউচপাড়ায় বিয়ে বাড়িতে ব্রজপাতে নিহত হয় ২ জন, আহত হয় ২ জন। এছাড়াও ব্রজপাতে নাইক্ষ্যংছড়ি বাইশারীতে স্কুলশিক্ষকসহ আহত হয় আরো ৬ জন। নিহতরা হলো- খতিজা বেগম (৫৫), নূরনবী (৩০)। এরা বিয়ে বাড়ির সদস্য। আহতরা হলো- ছায়েরা খাতুন (২৮), জসিম উদ্দিন (১৯), কে.জি স্কুল শিক্ষক আবু নাসের (৪৫), মনছুর (১৮), আবুল কালাম (২০), সেলিম (১৬), নূরনবী (১৯) ও মোঃ নাজের। উপর্যুপরি ব্রজপাতে হতাহতের ঘটনায় নাইক্ষ্যংছড়িসহ আশপাশের ২শ গ্রামের ৪ লক্ষাধিক মানুষ চরম আতংকে রয়েছে। উল্লেখ্য, ব্রজপাতে এই এলাকায় গত ৫ বছরে ২১ জন নিহত, আহত হয় অর্ধশত। এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি ইউএও নওয়াব আসলাম হাবিব জানান- পাহাড়ি ঢলের অনেক জায়গায় ক্ষতি হয়েছে।
চকরিয়া প্রতিনিধি ছোটন কান্তি নাথ জানান, টানা ১০ ঘন্টার প্রবল বর্ষণ ও বিভিন্ন ছড়া খাল দিয়ে দ্রুত নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঢলের পানির তোড়ে কয়েকটি ইউনিয়নের অন্তত ১৫টি কাঁচা বসতবাড়ি বিধ্বস্ত ও অসংখ্য গ্রামীণ সড়ক ভেঙে গেছে। এছাড়া সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের ভূট্টা ও সবজি ক্ষেতসহ কয়েক’শ একর জমির সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। অপরদিকে সামুদ্রিক জোয়ারের অস্বাভাবিক পানির তোড়ে উপকূলীয় এলাকার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের বেড়িবাঁধসহ চিংড়ি ঘেরেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানরা জানিয়েছেন। এদিকে, টানা প্রবল বর্ষণ ও ভয়াবহ বজ্রপাতের কারণে রোববার রাত থেকে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চকরিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। রামু প্রতিনিধি নীল অপূর্ব জানান, কক্সবাজারের রামু উপজেলায় প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে গত রোববার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের দোছড়ি খালের উপর নির্মিত সেতু ও ফাক্রিকাটা এলাকায় দু’টি সেতু ভেঙ্গে গেছে। এতে রামু সদরের সাথে ওই এলাকার পঞ্চাশ হাজার মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্লাবনে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ কয়েক’শ ঘরবাড়ি পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। একাধিক স'ানে বাঁকখালী নদীর পানি প্রবেশ করায় নতুন নতুন ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। বাঁকখালী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় স্রোতে ভেসে গেছে প্রায় ৫০ লাখ টাকার বাঁশ ও গাছ। পেকুয়া প্রতিনিধি মো. ছফওয়ানুল করিম জানান, অতিবৃষ্টির কারণে জোয়ারের পানি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে পেকুয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে করে ফসলি জমি চিংড়ি ঘেরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, অতিবৃষ্টির কারণে পেকুয়া উপজেলার শীলখালী ইউনিয়ন, রাজাখালী, মগনামা, উজানটিয়া ও টৈটং এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শীলখালী ও টইটং ইউনিয়ন পাহাড়ি ঢলের পানিতে এবং রাজাখালী, মগনামা ও উজানটিয়া ইউনিয়ন ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছে শীলখালী ইউনিয়নের জারুল বনিয়া সড়ক সহ কমপক্ষে ২০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক পানির নীচে তলিয়ে গেছে। এদিকে মগনামা উজানটিয়া ও রাজাখালী ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ভাঙ্গা বেড়ী বাঁধের অংশ দিয়ে পানি ঢুকে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কমপক্ষে ১৫০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় জনসাধারণের দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে। টইটং ইউনিয়নের কৃষক আবু তালেব, সৈয়দ আলী, আবুল কাশেম, শীলখালীর জব্বর মিয়া, পেকুয়া সদরের রমিজ উদ্দিন ও জহিরুল ইসলাম জানান, পেকুয়া উপজেলার প্রায় সবকটি বীজতলা পানির নীচে তলিয়ে গেছে। দ্রুত পানি না নামলে বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে তারা জানান।
উখিয়া প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম জানান, আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নে চার গ্রামে অর্ধশত বসতঘর, গাছপালা ভেঙে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল ছ’টার দিকে এ ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। গত কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে উখিয়ার সর্বত্র গ্রামীণ রাস্তাঘাট, চিংড়ি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পালংখালী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার নুরুল হুদা চৌধুরী, ৩নং ওয়ার্ড গ্রাম পুলিশ নুরুল আলম জানান, পশ্চিম পালংখালী, গয়াল মারা, পুটি বনিয়া ও রাহমতের বিল গ্রামে ঘূর্ণিঝড়ে অর্ধশত বসত ঘর, শত শত গাছপালা উপড়ে ভেঙে ব্যাপক ক্ষতি হয়। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমী বায়োচাপ ও পূর্ণিমার প্রভাবে গত ২/৩ দিন দরে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে অনেক গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অনেক গ্রামীণ রাস্তা-কালভার্ট বিধ্বস্ত হয়েছে, নাফ নদী ও সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চল ও ৩০টির মত চিংড়ি ঘের প্লাবিত হয়ে চিংড়ি মাছ ভেসে গেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন