পরপর দুবছর বর্ষাকালে চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও নগরীর প্রায় ৩০টি পাহাড়ের চূড়া, ঢাল, পাদদেশ এবং আশপাশের এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর জরিপ চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এসব বসতি চিহ্নিত করে। পরিবেশ অধিদপ্তর এসব বসতি সরিয়ে নেওয়ারও সুপারিশ করেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, নগরীর অতি ঝুঁকিপুর্ণ বসতিতে বাস করছে প্রায় দুই হাজার পরিবার। আর কম ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে আছে চার থেকে পাঁচ হাজার পরিবার।
এসব বসতি অবৈধভাবে স্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুস সোবহান বলেন, “বসতি স'াপনকারীদের সরানো না গেলে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।” তিনি দাবি করেন, “ছিন্নমূলদের সামনে রেখে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি পাহাড়ে বসতি গড়েছে।” চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ স'ান থেকে বসতি সরিয়ে নেওয়া না হলে এবারও বর্ষায় বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।”
তিনি বলেন, “অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো থেকে শুধু বসতি সরানো নয়, পাহাড় সুরক্ষারও উদ্যোগ নিতে হবে।” পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ৩০টি পাহাড়ের মধ্যে নয়টি পাহাড়ই ওয়াসা, রেলওয়ে, সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের। খবর বিডিনিউজের।
অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হল- নগরীর কুসুমবাগ এলাকায় পুলিশ লাইন, গরীবুল্লাহ শাহ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, ওয়াসা নিয়ন্ত্রণাধীন মধ্য মতিঝর্ণা পাহাড় ও সংলগ্ন এলাকা, ইস্পাহানি টেক্সটাইল মিল সংলগ্ন গোল পাহাড়, উত্তর পাহাড়তলীর লেকভিউ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, বায়েজীদ এলাকার ট্যাংকির পাহাড়, সিরাজ শাহ কলোনি ও আমিন টেক্সটাইল, মেডিকেল কলেজের স্টাফ কোয়ার্টার সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশ ও ঢালের বসতি।
কম ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় আছে- বিশ্ব কলোনি, উত্তর কাট্টলী নন্দন হাউজিং, খুলশী ব্রিক ফিল্ড, দক্ষিণ খুলশী জাকির হোসেন সোসাইটি, দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকাসহ একই এলাকার আরেকটি পাহাড়, এসবি নগর, খুলশী ভ্যালি আবাসিক এলাকা, সূচনা ভিআইপি আবাসিক এলাকা, ডলফিন, কিং অব চিটাগাং কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন পাহাড় ও সামারা হিলের পাদদেশসহ আশপাশের বসতি।
২০০৭ সালের ১১ জুন নগরীর লালখান বাজারে মতিঝর্ণা এলাকায় ওয়াসার টাঙ্কির পাহাড়, কুসুমবাগ এলাকা মহানগর পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন পাহাড়, সেনানিবাস সংলগ্ন কাইচ্যাঘোনা, লেবু বাগানসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে ১২৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। এ ঘটনায় বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত ও বিশেষজ্ঞ কমিটি পাহাড় কাটা বন্ধ ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসতি স্থাপন নিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করলেও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এসব সুপারিশে নির্বিচারে পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তি, সংস'া ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশ ও ঢাল থেকে বসতি সরিয়ে নিতে বলা হয়।
গত বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করা পরিবারগুলোকে সরিয়ে নিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় ছিন্নমূলরা সেসব স্থানে বসতি গড়ে তোলে। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট আবারও টাঙ্কির পাহাড় ধসে ১১ জনের মৃত্যু হয়।
বিভাগীয় কমিশনার এম এন সিদ্দিক বলেন, “অনেক স্থান থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।” তবে কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অনেক বসতি স্থাপনের বিষয়টি তিনি শুনেছেন বলে জানান। ঝুঁকিপূর্ণ বসতি চিহ্নিত করা এবং পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুস সোবহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইতোমধ্যে ফয়’স লেক সংলগ্ন উত্তর খুলশী এলাকার পাহাড় থেকে অবৈধ বসতি সরিয়ে নিতে রেলওয়েকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই অন্য পাহাড়গুলো থেকে বসতি সরিয়ে নিতে নোটিশ দেওয়া হবে।”
পাহাড় কাটা আইন দুর্বল হওয়ায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, “নোটিশ দেওয়ার পর এসব স্থান থেকে বসতি সরানো না হলে প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে উচ্ছেদ করা হবে।” এ বিষয়ে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী শরীফ চৌহান বলেন, “প্রশাসনের যথাযথ উদ্যোগের অভাব এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসতি উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না।” পাহাড় কাটা আইন সংশোধনসহ এর কঠোর প্রয়োগের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান তিনি।