আজ সংসদে বাজেট পেশ ।। পাঁচটি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারকে মাথায় রেখে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সঙ্কট বিবেচনায় পাঁচটি বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট তৈরি করেছেন অর্থমন্ত্রী। আজ বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত নয়া বাজেট পেশ করবেন। এরপর বাজেটের ওপর আলোচনা করে আগামী ৩০ জুন তা সংসদে পাস করা হবে। ২০০৯-১০ অর্থ বছরের বাজেটের আকার হতে পারে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা।
অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং বিশ্বমন্দা মোকাবেলায় সার্বিক অর্থনৈতিক সি'তিশীলতা নিশ্চিতকরণ। যে পাঁচটি খাতে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে সেগুলো হলোণ্ড বিদ্যুৎ, কৃষি, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা এবং যোগাযোগ। ইশতেহারে দেয়া নানা প্রতিশ্রুতির আলোকেই কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হবে এ অর্থবছরে যার বেশির ভাগই হবে ধাপে ধাপে। এসব কারণে এ বাজেটে বড় আকারের থোক বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বাজেটের আকারও বড় হচ্ছে এবং এ কারণে ঘাটতি বাজেটও বড় হচ্ছে। খবর এনএনবির।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল-ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সি'তিশীল রাখার ব্যবস'া করা হবে। দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস'া গ্রহণ করা হবে। মজুদদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও সি'তিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে। ইশতেহারের এ নীতি মেনেই বাজেটে নিত্যপণ্যের শুল্কহারে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
আসছে বাজেটে দাম বাড়বে যেসব পণ্য সেগুলো হলোণ্ড নিউজপ্রিন্ট, এয়ারকন্ডিশন, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজ, সেলুলার ফোন, গাড়ি, মোটরসাইকেল, চশমার ফ্রেম, মশার কয়েল, বিস্কুট, গ্লুকোজ, ইমিটেশন জুয়েলারি, স্যুটকেস, ভ্যানিটি ব্যাগ, ব্রিফকেস, স্কুল ব্যাগ, টুথব্রাশ, গৃহস্থালি, কিচেন ও বাথরুম উপকরণ, সব ধরনের টাইলস, ড্রাইসেল ব্যাটারিসহ ১৫২টি পণ্য।
নতুন এ বাজেটে দাম কমার তালিকায় রয়েছে এমন পণ্যের মধ্যে রয়েছেণ্ড শিল্পের কাঁচামাল, ওষুধের কাঁচামাল, রাবার ও প্লাস্টিক, শিক্ষাবিষয়ক বই, ফ্লোরোসেন্ট এনার্জি সেভিং বাল্ব ও যন্ত্রাংশ, ফটোভোল্টিক সেল, ৩০০০ ডিডব্লিউটি ক্ষমতার সাগরে চলাচলের জাহাজ, খাদ্য তৈরির উপকরণ, অর্থোপেডিক চিকিৎসার ওষুধ, পাল্প, ফসফরিক এসিড, হাইব্রিড মোটরকার ইত্যাদি।
সূত্র জানায়, আসছে বাজেটে ১২ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শূন্য আমদানি শুল্ক করা হচ্ছে। এর মধ্যে চাল-ডাল, আটা, পিঁয়াজ-রসুন, তাজা মাছ ও তাজা সবজি ইত্যাদি রয়েছে। এ ছাড়া ভোজ্যতেল, মাশরুম ও পামতেলসহ ৮ পণ্যে শুল্ক কমানো হচ্ছে। ভোজ্যতেলের দাম কমাতে আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এ ছাড়া ভোজ্যতেল আমদানিতে ল্যান্ডিং চার্জ আড়াই শতাংশে নামিয়ে আনা হচ্ছে। ভোজ্যতেল আমদানিতে ব্যবসায়ীদের শতকরা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। এর সঙ্গে ক্লিয়ারিং চার্জ, ইন্স্যুরেন্স এবং এলসি কমিশন মিলে আরো প্রায় ৫ শতাংশ ব্যয় হয়। সব মিলিয়ে শতকরা ২০ ভাগ অতিরিক্ত খরচ যোগ হয় এলসি মূল্যের সঙ্গে। নয়া বাজেটে এ দুটি খাতে প্রায় ৫ শতাংশ শুল্ক কমানো হচ্ছে। ভোজ্যতেলের পাশাপাশি পামওয়েলের ক্ষেত্রেও একই হারে শুল্ক নির্ধারণ করা হচ্ছে। এছাড়া সব ধরনের পাখি, মানবদেহের ভ্যাকসিন, গবাদিপশুর খাদ্য, মাশরুম গাছের চারা, মাছের পোনার আমদানি শুল্ক কমানো হচ্ছে।
নিত্যপণ্য ছাড়াও সরকার নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ৩ শতাংশ কমানো হচ্ছে। এসব পণ্যে আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হচ্ছে।
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষি উপকরণ যেমন ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইকলসহ বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন সংশ্লিষ্ট পণ্যে আমদানি শুল্ক ৩ শতাংশ কমানো হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে কাস্টম ডিউটি সম্পূরক শুল্ক অব্যাহত রেখে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদনে কৃষকদের প্রণোদনা দিতে ধানবীজ আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে।
বাজেটে সংবাদপত্র শিল্পে প্রণোদনা দিতে শূন্য শুল্ক অব্যাহত রাখা হচ্ছে। সংবাদপত্র শিল্প মালিকরা প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়। ওই প্রস্তাবনা অনুযায়ী নয়া বাজেটেও নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে শূন্য শুল্ক অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক কমানোর পাশাপাশি বিলাসী ও স্বাস্থ্যহানিকর পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে নয়া বাজেটে। আসছে বাজেটে কমবেশি ৭৮ বিলাসী পণ্যে ৩ থেকে ৫ শতাংশ শুল্কহার বাড়ছে। বিলাসী পণ্যগুলোর মধ্যে কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ছে, আবার কিছু পণ্যে কাস্টম ডিউটি ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবনা থাকছে। যেসব পণ্যের শুল্ক বাড়ছে তার মধ্যে টিভি, ফ্রিজ, এয়ারকুলার, গাড়ি, মোবাইল সেট, টেলিফোন সেট, ল্যাম্প হোল্ডার, সব ধরনের কসমেটিকস, হেড ফোন, লাউড স্পিকার, ওয়াকিটকি, অটো জানালা, অটো দরজা, থাই গ্লাস, হেয়ার মেশিন, ঢেউটিন, ট্রান্সফরমার, পার্ট রেজার, স্যানিটারি দ্রব্য, ডায়মন্ড, স্বর্ণের কয়েন, কার্পেট, টাইলস, ফ্যাং টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, আর্ট কার্ড, ফ্লোটিং পেপার, মশার কয়েল, সেভিং দ্রব্য, সিডি-ভিসিডি, লেজার ফিল্ম, রঙ, উন্নতমানের জুতা, স্যুট, পোশাক, মাখন, রাবার, ম্যাচ, সব ধরনের আটাজাতীয় দ্রব্য, উন্নত মানের ফাস্টফুড, মিল্ক এবং ক্রিম।
এছাড়া স্বাস্থ্যহানিকর পণ্যের মধ্যে তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্যসহ সব ধরনের মদের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ আবার কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক একই রেখে কাস্টম ডিউটি, সম্পূরক শুল্কসহ অন্যান্য চার্জ ৩ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় শিল্পে প্রণোদনা দিতে দেশে উৎপাদিত বিলাসী পণ্যের শুল্ক কমানো হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত টিভি, ফ্রিজ, মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ ও জেনারেটরসহ বিলাসী পণ্যের শুল্ক কমানোর প্রস্তাবনা থাকবে নয়া বাজেটে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আগামী বছরের জন্য মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৭৯ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬১ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত খাতে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা এবং কর ব্যতিত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এনবিআর খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে দাঁড়াচ্ছে ৫৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত মিলিয়ে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬৯ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা, যা পরে সংশোধন করে ৬৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা করা হয়।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট অনুন্নয়নমূলক ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব ব্যয় ৬৯ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের মূল বাজেটে মোট অনুন্নয়নমূলক ব্যয় ৬৬ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে সংশোধিত বাজেটে ৬৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং রাজস্ব ব্যয় ৬২ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে অন্য লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়ন ব্যয় সঠিকভাবে না হলেও রাজস্ব ব্যয় বরং বেড়েছে।
চলতি বছরে উন্নয়ন ব্যয় অন্য বছরের তুলনায় কম হয়েছে। বছরের শুরুতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরা হলেও বাস্তবায়ন ব্যর্থতার কারণে সংশোধিত বাজেটে এডিপি বরাদ্দ কমিয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। নতুন বছরের বাজেটে এডিপি চূড়ান্ত করা হয়েছে ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দেশের চাহিদার কথা বলে সব সরকারের আমলেই এডিপির আকার বাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু বছর শেষে তা আর বাস্তবায়ন করা যায় না। এ রকম পরিসি'তিতে নতুন সরকারের এই বিশাল ব্যয়ের বাজেট কিভাবে বাস্তবায়িত হবে সে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
এদিকে সরকারকে ঘাটতি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণ বাড়াতে হবে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়ার ঝুঁকি থাকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে সরকার এক বছরের কম সময়ের বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিল, ট্রেজারি বন্ড এবং সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল।
অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধেও আগামী বছর সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হবে ১৪ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের বাজেটে ছিল ১১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ আগামী বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। যা চলতি বছরের মূল বাজেটে ১ হাজার ২৯১ কোটি টাকা ধরা হলেও বছর শেষে দাঁড়াচ্ছে ১ হাজার ৩১১ কোটি টাকায়।
উল্লেখ্য, দুই বছর পর আবার জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। গত দুই বছর সংসদের বাইরে বাজেট পেশ করা হয়েছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন